👉🏻 যুদ্ধ বলতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোরমধ্যে সুসংগঠিত এবং কখনও কখনও দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংঘর্ষকে বোঝায়। চারিত্রিক দিক দিয়ে এটি প্রচণ্ডসহিংস এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। যুদ্ধকে সবসময় রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে একটি বাস্তব, প্রায়োগিক ও বিস্তৃত সশস্ত্র সংঘর্ষ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু যুদ্ধ অনেক সময় অনেক সমস্যার ও সমাধান করে দেয় বা প্রকৃত মানুষদের তাদের অধিকার ও পাইয়ে দেয়। যেমন :- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
অামাদের বৈদিক ধর্মের ইতিহাস দেখলে দেখতে পাই যে তখন কার রাজা-রাজদের বিস্তৃত যুদ্ধের কাহিনী, আছে দেবাসুর সংগ্রামের কথাও।
যুদ্ধ শুধু ধ্বংসের কারণ না, যুদ্ধ নতুন করে শুরু করার ও একটি মাধ্যম। যেমনটা আমরা মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বর্ণনা থেকে পাই।
সনাতন ধর্মের শাস্ত্রাদিতে যুদ্ধনীতি সম্পর্কিত বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে , এখানে সেটার কিঞ্চিৎ মাত্র অালোচনা করছি।
প্রথমত যুদ্ধ নীতি সম্পর্কিত সনাতন ধর্মের অালোকে কিছু প্রশ্ন করা যাক---
১) যুদ্ধ করাটা কি বাধ্যতামূলক?
২) যুদ্ধ না করে কি সন্ধি করা যায় না?
৩) যুদ্ধ কিরুপ শাসকের বিরুদ্ধে করা উচিত?
৪) যুদ্ধে যারা অংশ নেবে তাদের নিরাপত্তা কিরুপ হওয়া উচিত?
৫) যুদ্ধে যারা নিহত হবে তাদের পরিবারের ভরণপোষণ কে করবে?
৬) যুদ্ধে যে সমস্ত ধন সম্পত্তি লাভ হবে সেগুলোর কি হবে?
৭) যুদ্ধে অংশ নেয়া শত্রুপক্ষের সব সৈন্যদের হত্যা করাটা কি বাধ্যতামূলক?
৮) যুদ্ধে পরাজিত রাজ্যের শাসন ক্ষমতা কার হাতে থাকবে?
৯) যুদ্ধে পরাজিত রাজ্যের প্রজাদের সাথে কিরুপ ব্যবহার করবে?
১০) যুদ্ধে পরাজিত রাজ্যের ধর্ম ব্যবস্থা কি একই থাকবে নাকি নতুন ধর্ম প্রথা চালু করবে?
👉🏻👉🏻 এসব সম্পর্কে কি বলে সনাতন ধর্ম ❓❓❓
একজন আদর্শ রাজার জন্য যুদ্ধ করাটা বাধ্যতামূলক নয়, কেননা যুদ্ধ সবসময় ক্ষতির দিকটার পাল্লা ভারী থাকে , তবে যদি কেউ রাজাকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করে তবে অবশ্যই ক্ষাত্র ধর্ম পালনের জন্য যুদ্ধ করতে হবে--
-সমােত্তমাধমৈরাজা ত্বাহুতঃ পালয় প্রজাঃ।
-ন নিৰ্বৰ্ত্তেত সংগ্রামাৎ ক্ষাত্রং ধর্মমনুস্মরন্।।
(মনু- ৭/৮৮)
---
★অনুবাদ★
----"এতদ্বারা বিদ্যোন্নতি হওয়াতে রাজ্যের অশেষ শ্রীবৃদ্ধি হইয়া থাকে। প্রজাপালক রাজাকে তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট, নিকৃষ্ট অথবা ততুল্য কেহ কখনও সংগ্রামে আহ্বান করিলে তিনি ক্ষাত্র ধর্ম স্মরণ করিয়া যুদ্ধ যাত্রায় নিবৃত্ত হইবেন না। অর্থাৎ তিনি এইরূপ কৌশল সহকারে তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবেন, যেন নিশ্চিত রূপে নিজের বিজয় লাভ হয়।"
.
👉🏻যুদ্ধের জন্য কয়েকটা দিক জানাটা জরুরী, যেমন--- রাজা যুদ্ধ করার জন্য সকল সরঞ্জাম আছে যেটা দিয়ে জয়লাভ করা সম্ভব? নাকি যুদ্ধে গেলে নিজের রাজ্যের হানি হবে? এক্ষেত্রে কি সন্ধি করা হবে?
.
👉🏻এর উত্তরে বলা যায় যে---
---য়দাবগচ্ছেদায়ত্যামাধিক্যং ধ্রুবমাত্মনঃ।
-তদাত্বে চাল্পিকাং পীডাং তদা সন্ধিং সমায়েৎ।।
(মনু- ৭/১৬৯)
★অনুবাদ★
---যখন জানা যাইবে যে, অমুক সময়ে যুদ্ধ হইলে কিছু কষ্টে পড়িবে, কিন্তু তাহার পরে যুদ্ধ করিলে আপন বুদ্ধি ও বিজয় লাভ অবশ্য হইবে, তখন শত্রুর সহিত সন্ধি করিয়া উচিত সময় পর্যন্ত ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিবেন ||
.
-য়দা প্রহৃষ্টা মন্যেত সর্বাস্তু প্রকৃতীৰ্ভশম্।
-অত্যুচ্ছিতং তথাত্মানং তদা কুবীত বিগ্রহম।।
(মনু- ৭/১৭০)
★অনুবাদ★
--- যখন নিজের সমস্ত প্রজা অথবা সেনা অত্যন্ত প্রসন্ন, উন্নতিশীল এবং উৎকৃষ্ট বলিয়া মনে হইবে এবং নিজেকেও সেইরূপ মনে করিবেন, তখনই শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিবেন।"
.
উপরিউক্ত বিষয় থেকে জানা যাচ্ছে যে যুদ্ধ করবেন যদি অাপনার সামর্থ্য থাকতে যুদ্ধে জয় লাভ করার, নচেৎ যুদ্ধ না করে সন্ধি করুন। 🤝
.
👉🏻 সৈন্যসামন্তদের নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে শাস্ত্রের অভিমত হলো---
-স্যন্দনাশ্বৈঃ সমেয়ুধ্যেদপে নৌদ্বিপৈস্তথা।
-বৃক্ষগুল্মবৃতে চাপৈরসিচৰ্মায়ুধৈঃ স্থলে।।
-প্রহর্ষয়েদ্বলং ব্যুহ্য তাশ্চ সম্যক্ পরীক্ষয়েৎ।
-চেষ্টাশ্চৈববিজানীয়াদরী মােথয়তামপি৷৷
(মনু- ৭/১৯৩-১৯৪)
★অনুবাদ★
--সমতলভূমিতে যুদ্ধ করিতে হইলে রথ, অশ্ব এবং পদাতিক লইয়া, সমুদ্রে যুদ্ধ করিতে হইলে নৌকা দ্বারা, অল্প অল্প জলে যুদ্ধ করিতে হইলে হস্তী দ্বারা, বৃক্ষোপরি ও ঝােপের মধ্যে যুদ্ধ করিতে হইলে ধনুর্বাণ দ্বারা এবং বালুকাময় স্থানে যুদ্ধ করিতে হইলে ঢাল ও তরবারির দ্বারা যুদ্ধ করিবেন ও করাইবেন। ১৯৩
-যুদ্ধকালে যােদ্ধাগণকে উৎসাহিত ও আনন্দিত করিবেন। যুদ্ধ স্থগিত হইলে শৌর্য্য ও উৎসাহবৰ্ধক বক্তৃতা, ভােজ্য,পানীয়, অস্ত্রশস্ত্রের সহায়তা এবং ঔষধাদি দ্বারা সকলের চিত্ত প্রসন্ন রাখিবেন। ব্যুহ ব্যতীত যুদ্ধ করিবেন না ও করাইবেন না। যুদ্ধনিরত সৈন্যদের কাৰ্য্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিবেন। তাহারা যথার্থ যুদ্ধ করিতেছে,—না কপটতা করিতেছে, তাহা লক্ষ্য করিবেন ॥
.
👉🏻যুদ্ধে সৈন্যসামন্ত নিহত হোক বা না হোক রাজার কর্তব্য হলো প্রজাদের সন্তানের মতো দেখা। তাই রাজ্যের অসমর্থ ও অনাথদের পালন করা রাজার ধর্ম---
-অলব্ধং চৈব লিপ্সেত লব্ধং রক্ষেৎ প্রয়ত্নতঃ।
-রক্ষিতং বর্ধয়েচ্চৈব বৃদ্ধং পাত্রে নিঃক্ষিপেৎ ॥
(মনু- ৭/৯৯)
★অনুবাদ★
-রাজা এবং রাজসভা অলব্ধ ধন পাইবার ইচ্ছা করিবেন, লব্ধ ধন যত্ন সহকারে রক্ষা করিবেন, রক্ষিত ধনের বৃদ্ধি করিবেন এবং বর্ধিত ধন বেদবিদ্যা, বিদ্যার্থী, বেদোপদেশক, অসমর্থ ও অনাথদিগের প্রতিপালনের জন্য ব্যয় করিবেন |
.
যুদ্ধে প্রাপ্ত ধন সম্পত্তি অবশ্যই বিজিত রাজ্য লাভ করবে, এরুপ শাস্ত্রের নির্দেশ--
--রথাশ্বং হস্তিনং ছত্রং ধনং ধান্যং পশূন্ স্ক্রিয়।
--সর্বদ্রব্যাণি কুপ্যং চ য়াে য়জ্জয়তি তস্য তৎ৷।
(মনু- ৭/৯৬)
★অনুবাদ★
-- "যুদ্ধে যে রথ, অশ্ব, ছত্র, ধন, ধান্য, গবাদি পশু, নারী এবং অন্য সকল প্রকার দ্রব্য, ঘৃত, তৈলের কলস প্রভৃতি যাহা যাহা জয় করিবেন, তিনি তাহা প্রাপ্ত হইবেন।
.
👉🏻যুদ্ধে গেলেই হত্যা করতে হব এরুপ নির্দয়তা শাস্ত্র দেয়নি, যুদ্ধে কাদেরকে হত্যা করা যাবেনা সেটার একটি বিবরণ নিম্নরূপ ---
-নচ হন্যাৎ স্থলারূটংন ক্লীবংন কৃতাঞ্জলি।
-নমুক্তকেশংনাসীনংন তবাশ্মীতি বাদিন ৷৷
-ন সুপ্তং ন বিসন্নাহংননগ্নংন নিরায়ুধ।
-নায়ুধ্যমানং পশ্যন্তংন পরেণ সমাগত৷৷
-নায়ুধব্যসনং প্রাপ্তংনাত্তং নাতিপরিক্ষত।
-ন ভীতংন পরাবৃত্তং সতাং ধর্মমনুস্মর।।
(মনু- ৭/৯১-৯৩)
★অনুবাদ★
-যাহারা যুদ্ধকালে ইতস্ততঃ দাঁড়াইয়া থাকে, যাহারা নপুসংক, কৃতাঞ্জলি, উন্মুক্তকেশ ও উপবিষ্ট; যাহারা বলে আমি তােমার শরণাগত।" ৯১
-যাহারা নিদ্রিত, মুচ্ছিত, নগ্ন, অস্ত্র-শস্ত্রহীন, যুদ্ধদর্শক, শত্রুর সঙ্গী। ৯২
-যাহারা অস্ত্র-শস্ত্রাঘাতে পীড়িত, দুঃখগ্রস্ত(মৃত শোকে কাতর), অত্যন্ত আহত, ভীত এবং পলায়নপর, এতাদৃশ যােদ্ধৃগণ সৎপুরুষদের ধর্ম স্মরণ করিয়া তাহাদিগকে কখনও বধ করিবেন না। ৯৩
.
যুদ্ধে সাধারণত দেখা যায় যে কোনো দেশ বিজয় করলে উক্ত দেশে বিজিত দেশের শাসনকর্তা দেশ পরিচালনা করে। কিন্তু মহর্ষি মনুর মতে পরাজিত রাজ্যে গুনবান ধার্মিক থাকলে তাকেই রাজ্য পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া যেতেই পারে, এই সম্পর্কে বলা অাছে যে---
-প্রমাণানি চকুৰীত তেষাং ধর্মান্যথােদিতা।
-রত্নেশ্চ পূজয়েদেনং প্রধানপুরুষেঃ সহ।।
(মনু- ৭/২০৩)
★অনুবাদ★
---বিজয় লাভের পর শত্রুর সহিত প্রমাণ অর্থাৎ প্রতিজ্ঞা পত্রাদি লিখাইয়া লইবেন, এবং উচিত সময়ে মনে হইলে তাহারই বংশের কোন ধার্মিক পুরুষকে এই শর্তে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিবেন—“আপনাকে আমার আজ্ঞা অর্থাৎ ধর্মানুমােদিত রাজনীতি অনুসারে কাৰ্য্য করিয়া ন্যায় পথে প্রজা পালন করিতে হইবে। এইরূপ উপদেশ প্রদান করিয়া তাহার সন্নিকটে এমন লােক রাখিবেন, যাহাতে পুনরায় উপদ্রব না হয়। প্রধান পুরুষদের সহিত মিলিত হইয়া শত্রুকে রত্নাদি উত্তম সামগ্রী প্রদান পূর্বক সম্মানিত করিবেন। এমন কাৰ্য্য করিবেন না, যাহাতে তাহার যােগক্ষেমও সিদ্ধ না হয়। তাহাকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখা হইলেও তাহার প্রতি যথাযােগ্য সম্মান প্রদর্শন করিবেন, যেন সে মনস্তাপ বিস্মৃত হইয়া আনন্দে থাকিবে পারে।
.
যুদ্ধে জয়ের পর
বিজিত রাজা পররাজ্যের পালনকৃত ধর্মসংস্কৃতি পরিবর্তন করবেনা ইহাই সনাতন শাস্ত্রের বিধান ---
-জিত্বা সম্পািজয়েদেবান ব্ৰাহ্মণাংশ্চৈব ধামিকান।
-প্রদদ্যাৎ পরিহারাংশচ খ্যাপিয়েদভয়ানি চ৷।
(মনু- ৭/২০১)
★অনুবাদ★
-রাজা পররাষ্ট্র জয় করিলে পর, শক্ররাজ্যে সংস্থাপিত যে সকল দেবালয়, প্রসিদ্ধ দেবতা এক তক্তদেশবাসী ধাৰ্ষিক যে সকল ব্রাহ্মণ, ইহাদিগকে বিজিত দ্রব্যের একাংশ হইতে ভূমি ও মুখরি গ্রব্য দান এবং সন্মান দ্বারা পূজা করিবেন, তত্ত্বত্য সকলকে অভয়দান করিবেন(যাতে তারা ভীত ভাবে জীবনযাপন না করে)।
.
উপরের একটি পয়েন্ট এর উত্তর পুরোপুরি করা হয়নি, সেটা হলো বিজিত দ্রব্যের কি হবে সেটার শাস্ত্রীয় প্রমাণ কোথায়?
সেটার শাস্ত্রীয় প্রমাণ নিম্নরুপ---
-আদানমপ্রিয়করংদানঞ্চ প্রিয়কারক।
-অভীপ্সিতানামর্থানাং কালে য়ুক্তং প্রশস্যতে৷।
(মনু- ৭/২০৪)
★অনুবাদ★
-যেহেতু সংসারে অন্যের সম্পত্তি গ্রহণ করা অপ্রীতিকর এবং অপরকে দান করা প্রীতিকর, এইজন্য বিশেষ করিয়া সময়ােচিত কর্ম করা এবং পরাজিত শত্রুকে তাহার মনােবাঞ্ছিত সামগ্রী প্রদান করা অতি উত্তম। কখনও শত্রুকে বিদ্রুপ করিয়া উত্যক্ত করিবেন না এবং "তােমাকে জয় করিয়াছি"এরূপ কথা বলিবেন না। কিন্তু তাহাকে সম্মান সূচক বাক্য বলিয়া তাহার সহিত সদ্ব্যবহার করিবেন।"
উক্ত শ্লোক অনুসারে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে অপরের দ্রব্য গ্রহণ করা প্রীতিকর নয় সুতরাং এটা দান করায় শ্রেয়।
.
অতএব পরিশেষে বলা যায় যে সনাতন ধর্মের যুদ্ধনীতিকে মানবতাবাদী নীতি বলা চলে।
.