বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৬।৪।১৮ কণ্ডিকা নিয়ে একটা শঙ্কা আমাদের সামনে প্রায়শই উঠে। শঙ্কটা এরূপ যে, গর্ভস্থ পুত্র বা সন্তান যেন বিদ্বান হয় সেইজন্য স্বামী স্ত্রী উভয়ে বৃষের মাংস দ্বারা পাককৃত অন্ন আহার করবে। প্রায় সব অনুবাদক এমনটাই অনুবাদ করেছে। অর্থাৎ ইহা দ্বারা সনাতন ধর্মে গোমাংস খাওয়ার বিধান সিদ্ধ এমনটা দাবী করে অপপ্রচারকারীরা।
মূলত আমাদের ধর্মের মূল স্রোত হলো বেদ। বেদের জ্ঞানকে অবলম্বন করেই পরবর্তীতে অনেক শাস্ত্র রচিত হয়েছে। সেই বেদে আমরা গোহত্যার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ পাই। গো হত্যা সম্বন্ধে বেদ বলছে যে,
"মা গামানাগামদিতিং বধিষ্ট"
(ঋগবেদ ৮।১০১।১৫)
অর্থাৎ নিরপরাধ গাভী এবং ভূমিতূল্য গাভীকে কখনো বধ করো না।
শুধু তাই নয় গোহত্যাকারীকে দন্ডের বিধান দিয়ে বেদ বলছে যে -
যদি আমাদের গাভীকে হিংসা কর যদি অশ্বকে যদি মনুষ্যকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসক দ্বারা বিদ্ধ করিব। (অথর্ববেদ ১।১৬।৪)।
বেদের জ্ঞানকাণ্ডের ব্যাখ্যাভাগ হওয়ার হেতু উপনিষদে গোমাংস আহারের নির্দেশ কদাপি থাকতে পারে না।
আমাদের স্থূল বিচার বিবেচনার জন্যই মূলত এরূপ শঙ্কার উদ্ভব হয়েছে। আসুন বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিত বিশ্লেষন করা যাক -
অথ য ইচ্ছেৎ পুত্রো মে পন্ডিতো বিজিগীতঃ সমিতিঙ্গমঃ শুশ্রুষিতাং বাচ্য ভাষিতা জায়েত সর্বাণ বেদাননুববীত সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাষৌদনং* পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তমশ্নীয়াতামীশ্বরৌ জনয়িতবা ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা।।
(বৃহঃ উপঃ ৬।৪।১৮)
*পাঠভেদ মাঁসৌদনং ও মাংসৌদনং
শব্দার্থঃ (অথ যঃ ইচ্ছেত্ পুত্রঃ মে) এবং যে এই ইচ্ছা করে যে আমার পুত্র (পন্ডিতঃ) বিদ্বান (বিজিগীথঃ) প্রসিদ্ধ (সমিতিয় গমঃ) সভায় গমন যোগ্য (শুশ্রুষিতাম বাচম্ ভাষিতা) আদরের সহিত শ্রবণ যোগ্য ভাষনকারী (জায়েত) হবে (সর্বাণ বেদাননুববীত সর্বম্ আয়ু ইয়াত্ ইতি) সমস্ত বেদের জ্ঞাতা পূর্নায়ুর উপভোক্তা হবে তো (মাষৌদনম্)
মাষের [কলাই বিশেষ] সাথে চাউল (পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তম্ অশ্নীয়াতাম্ ইশ্বরী জনয়িতবৈঃ) পাক করে ঘৃতের সাথে উভয়ে [স্বামী স্ত্রী] আহার করে তো (অপেক্ষেত পুত্র) পুত্র উৎপন্ন করতে সমর্থ হবে
(ঔক্ষেণ বা আর্ষভেণ) ঔক্ষ দ্বারা অথবা ঋষভ দ্বারা।
সরলার্থঃ এবং যে এই ইচ্ছা করে যে আমার পুত্র বিদ্বান প্রসিদ্ধ সভায় গমন যোগ্য আদরের সহিত শ্রবণ যোগ্য ভাষনকারী হবে, সমস্ত বেদের জ্ঞাতা পূর্নায়ুর উপভোক্তা হবে তো মাষের [কলাই বিশেষ] সাথে চাউল পাক করে ঘৃতের সাথে উভয়ে [স্বামী স্ত্রী] আহার করে তো পুত্র উৎপন্ন করতে সমর্থ হবে ঔক্ষ দ্বারা অথবা ঋষভ দ্বারা।
তাৎপর্যঃ এই কণ্ডিকার মধ্যে বর্ণিত পুত্র প্রাপ্তির জন্য বলা হয়েছে যে, মাষের সাথে পাককৃত চাউল ঔক্ষ বা আর্ষভের সাথে আহার করা উচিৎ। এই পুত্র এবং পুত্রি উৎপন্ন করার জন্য অপেক্ষিত সাধনের কাজে নেবার শিক্ষাকে সমাপ্ত করে ইহা বলা হয়েছে যে, সব প্রকারে পুত্র কে উৎপন্ন করা আদির কৃত্য ঔক্ষ এবং আর্ষভ বিধি দ্বারা করা উচিৎ।
কতিপয় অনুবাদক বলতে চান মাষৌদনম্ বা মাংসৌদনম্ এর অর্থ হবে মাংস মিশ্রিত অন্ন এবং মাংসটি হবে উক্ষের অথবা ঋষভের যার অর্থ তাদের মতে যথাক্রমে তরুণ বৃষ বা বয়স্ক বৃষ।
আমরা যদি এই কণ্ডিডকার পূর্বের চারটি কণ্ডিকা খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাই
কণ্ডিকা ১৪: যদি কেও চায় তার পুত্র
এক বেদ অধ্যয়ন করুক তবে স্বামী-স্ত্রী যেন ক্ষীরৌদন অর্থাৎ পায়েস মিশ্রিত অন্ন রান্না করে ঘি মিশিয়ে খায়।
কণ্ডিকা ১৫: যদি কেও চায় তার পুত্র
দুই বেদ অধ্যয়ন করুক তবে স্বামী-স্ত্রী যেন দধ্যৌদন অর্থাৎ দধি মিশ্রিত অন্ন রান্না করে ঘি মিশিয়ে খায়।
কণ্ডিকা ১৬: যদি কেও চায় তার পুত্র
তিন বেদ অধ্যয়ন করুক তবে স্বামী-স্ত্রী যেন উদৌদন অর্থাৎ জলে সেদ্ধ অন্ন রান্না করে ঘি মিশিয়ে খায়।
কণ্ডিকা ১৭: যদি কেও চায় তার কন্যা বিদুষী হোক তবে স্বামী-স্ত্রী যেন তিলৌদন অর্থাৎ তিল মিশ্রিত অন্ন রান্না করে ঘি মিশিয়ে খায়।
কণ্ডিকা ১৮: যদি কেও চায় তার পুত্র
চার বেদ অধ্যয়ন করুক তবে স্বামী-স্ত্রী যেন মাংসৌদন বা মাষৌদন অর্থাৎ মাংস বা মাষ মিশ্রিত অন্ন রান্না করে ঔক্ষ বা আর্ষভ
(আধুনিকগণের মতে তরুণ বা বয়স্ক বৃষের মাংস) এর সাথে খায়।
আয়ুর্বেদের মতে ক্ষীরৌদন, দধ্যৌদন, উদৌদন, তিলৌদন প্রভৃতি গর্ভবতী মায়ের জন্য ভেষজ পথ্য। অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি প্রথম চারটি কণ্ডিকাতেই ভেষজ খাবার গ্রহণের কথা আছে। এক বেদ, দুই বেদ, তিন বেদ এর জন্য ভেষজ তবে চারবেদের জন্য হুট করে ১৮শ কণ্ডিকা বৃষের মাংস খেতে বলছে, আসলেই কি তাই? তবে পশ্চিমা ও মুসলিমরা যারা গোমাংসে অভ্যস্থ তাদের সন্তানদেরই বড় বড় বেদবিৎ পণ্ডিত হওয়ার কথা।
১৪-১৭শ কণ্ডিকা সমূহের পর্যায় অনুযায়ী ১৮শ কণ্ডিকাতেও ভেষজ ঔষধ সম্বন্ধী পথ্য নির্দেশ দেওয়ারই কথা। তবে আসুন দেখে নেই আধুনিকগণ কর্তৃক অনুদিত ওই শব্দ সমূহের প্রকৃত তাৎপর্য কি?
মাষৌদনঃ যা বলা হয়েছিলো মাষৌদনে পাঠ ভেদ রয়েছে, অনেক গ্রন্থে মাংসৌদন। যদি মনে করে থাকেন সংস্কৃতে মাংস বলতে কেবল প্রাণীজ মাংসই বুঝে থাকেন তবে থামেন!!! ফল বা উদ্ভিদের রসালো অংশকেও মাংস বলা হয়ে থাকে। ইংরেজি "Flesh" এর অর্থও এমনটাই। এছাড়াও প্রাচীন কোষবিদগণ মাংস শব্দের এরূপ অর্থ করেছে যে,
মনঃ সীদত্যস্মিন স মাংসঃ যার দ্বারা মন প্রসন্ন হয় তাহাই মাংস
নিরুক্তেও মাংস শব্দের অর্থের মনন, সাধক, বুদ্ধিবর্ধক মন কে রুচি দানকারী বস্তুকে বলা হয়েছে। যা ফলের রসালো অংশ, ঘী, মাখন, ক্ষীর আদি পদার্থ
মাংস মাননং বা মানসং বা মনোস্মিনৎসীদতীতি : নিরুক্ত ৪।৩
এই দৃষ্টি দ্বারা মাষৌদন কে মাংসৌদন বলা যায়।
যে দশ ঔষধিকে দ্বারা মাষ এবং ওদন বর্ননার বিধান রয়েছে তার নাম স্বয়ং উপনিষদই উল্লেখ করেছে -
(i) ধান্য (ii) যব (iii) তিল (iv) মাষ (v) বাজরা (vi) প্রিয়জু (vii) গোধূম (viii) মসুর (ix) খল্ব (x) থলকুল।
(বৃহঃ উপঃ ৬।৩।১৩)
এখানে একটি বিষয়ে গভীর ভাবে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ যে, এই ঔষধির গণনা করে দেখা যাচ্ছে তিলের পরেই মাষের উল্লেখ রয়েছে। এইজন্য সতেরো কণ্ডিকায় তিলৌদন এবং তার পরে আঠারো কণ্ডিকায় মাষৌদনের উল্লেখ।
ঔক্ষঃ ঔক্ষ শব্দটি যার বিশেষণ অর্থাৎ উক্ষণ্ বা উক্ষা, এই উক্ষাকে আধুনিক অনুবাদকগণ তরুণ বৃষ ধরে অনুবাদ করে অনর্থ ঘটিয়েছে। ঔক্ষ শব্দ উক্ষ (সেচনে) ধাতু হতে এসেছে। উক্ষ দ্বারা উক্ষণ এবং উক্ষণের বিশেষন ঔক্ষ। অভিধানকারদের মতে উক্ষা দ্বারা সোম জাতীয় ভেষজ উদ্ভিদকেও নির্দেশ করে যার দ্বারা গর্ভবতী নারী সুস্বাস্থ্য লাভ করে। বাচস্পত্য বৃহৎ অভিধান অনুসারে উক্ষা অষ্টবর্গান্তর্গত ঋষভ ওষধের সমপর্যায়ী ভেষজ বলে দাবি করা হয়েছে।
আর্ষভঃ আর্ষভ - ঋষভ শব্দের বিশেষন। আয়ুর্বেদের মতে ঋষভও এক প্রকার ঔষধির নাম। সুশ্রুত সংহিতার মতে ২৭টি মহৌষধের মধ্যে একটি হচ্ছে ঋষভ এবং ভাব-প্রকাশের মতে অষ্ট বর্গীয় ভেষজের অন্যতম ঋষভ। এই ঋষভ উদ্ভিদ হিমালয় অঞ্চলে প্রধানত জন্মায়। এর পাতা গুলো বৃষের শিং এর ন্যায় পেচিয়ে থাকে।
তাই বলা যায় পূর্বোক্ত কণ্ডিকা সমূহের সাথে সাদৃশ্য বজায় রেখে, পর্যায় বাচক ক্রম অনুযায়ী এবং আয়ুর্বেদের মতে মাষৌদন, ঔক্ষ এবং আর্ষভ দ্বারা কোনো প্রাণীজ খাদ্য নয় বরং মাষের সঙ্গে উক্ষা বা ঋষভ নামক ভেষজ মিশ্রিত করে খাবার হিসেবে গ্রহণ করার কথাই বলা হয়েছে উক্ত কণ্ডিকায়।
★অগ্নিবীরের ব্লগ থেকে সংগ্রহ করা।
কথাটা মাংসৌদনং। মাষৌদনং নয়। ঔক্ষ মানে বয়স্ক ষাঁড়। ঋষভ মানে বলিষ্ঠ ষাঁড়। প্রাচীন ভারতে গোমাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন যজ্ঞে গোমাংস প্রসাদের উল্লেখ আছে। অশ্বমেধ যজ্ঞে ঘোড়ার মাংস আহুতি দেওয়ার প্রথা ছিল। এতে অসুবিধার কি আছে? বিভিন্ন যুগে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হতেই পারে। মিছিমিছি সত্যকে আড়াল করার কিম্বা উপনিষদের শব্দগুলিকে বিকৃত করার দরকার কি?
উত্তরমুছুন